Sunday, September 21, 2008

স্বাক্ষাতকার - 'কথা' অংশ৫

স্বাক্ষাৎকার - 'কথা' লিটল ম্যাগাজিন। (৪র্থ অংশের পর...)
আপনার 'কাছিমগালা' খুবই দরকারি এক গল্প মনে হয়। এর পটভূমি সম্পর্কে বলুন।

এখানে কিন্তু দুইটা জিনিস ছিল, আমরা যখন এগ্রিভার্সিটিতে পড়তাম, তখন ক্যাম্পাসটা আমাদের কাছে পুরা একটা সাম্রাজ্যের মত ছিল। আমরা যারা যা যা করার দরকার না তাই করতাম।
সেখানকার স্টুডেন্টদের লাইফটা হচ্ছে, ওরা ক্লাশ করবে, পড়বে, সন্ধ্যায় রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটবে; পাকারাস্তায় হাটবে, হলে ঘুমাবে এই আর-কি। আমরা পাকা রাস্তাকে অগ্রাহ্য করতাম। সবাই হয়ত ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছে, আমরা চায়ের দোকানে চইলা গেলাম। গল্পটা নিয়া যখন সেইসময়কার বন্ধুদের সাথে বলি তারা বলে যে, ওরা মনে করে এই গল্পটা লিখেছে ওরাই। মানে কাছিমগালা একটা সবার গল্প। ওইসময় আমি নিজেও ভাবতাম যে আমি বলে কিছু নেই। এটা যৌথমনের একটা ব্যাপার বলেই ধরে নিতাম। কারণ মানুষ তো একলা জীবনযাপন করে না। এইভাবে যুক্ততার ভিতরই কিছু হয়। আর তার নিজের জিনিসগুলি তো তার ভিতরে থাকেই, আবার অন্যের জিনিসগুলিও তার ভিতরে থাকে।

আমি ময়মনসিংহের পাঠ চুকাইয়া যখন জব লাইনে আসি, তখন আমার জবটাও ছিল এইরকম যে আমি অনেক জায়গায় ঘুরতাম। গল্পটাতে বিভিন্ন এলাকার বিষয় আছে। ময়মনসিংহের ভাষা তো আছেই, আবার মূল ক্যারেক্টারটা চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসলেও, সে কিন্তু রংপুর থাকত । যার ফলে সে কোন নির্দিষ্ট জায়গারও না।


সেখানে আপনার নিজস্ব উপস্থিতিও কিন্তু আমি টের পাই।
সটা তো আছেই, আমি যতগুলি গল্প লিখছি, তার কোনোটাই আমার অচেনা নয়। তো, যা বলছিলাম, আমি দেখতাম, ওই লোকটা নদী দিয়ে কাছিম শিকার করতে আসত। আবার সবাই মিলে শ্মশান-টশানে আড্ডা দিতাম যখন, তখন আমার শ্মশান বন্ধুরা রূপকথার গল্পের মত করে তাদের বাস্তবজীবনের গল্প শোনাত। এইসবের একটা যৌথ ব্যাপার ছিল। এটা কিন্তু আমার বিবাহপূর্ব জীবনের গল্প। তখন আমি ভাবতাম যে আমি বিয়ে-টিয়ে করব না। এটা নিয়া খুবই ইতরামি করতাম। ওইটাকে এস্টাব্লিস্ট করার তাগিদে ছোট্ট ইউনিটের একটা ফ্যামিলি আনলাম। এইসব ভাবতে-ভাবতেই বোধ হয় গল্পটটা তৈরি হইছে। এটা কিন্তু একটা অবাস্তব কন্ট্রাস্ট।

আপনার গল্পে দেখা গেল, মানুষ হয়ত বৃক্ষ হয়ে যাচ্ছে, মানুষের পেটে তিনশ বছর জীবনপ্রাপ্ত একটা কাছিমের বাচ্চা পয়দা হচ্ছে, তাহলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা আপনাকে তৃপ্ত করে না? আপনি কি মানুষের ভিতর প্রাণীর রূপান্তর নিয়ে কিছু ভাবেন?
না, তা না, আমি আসলে জীবনকে খুবই ক্রুড জায়গা থেকে ভাবি। কাছিমগালা গল্পটার কথাই ভাবেন - এখন কিন্তু ইউনিট ফ্যামিলি আরও আলগা হয়ে গেছে। এখন আর শতপুত্রের জননী না, এখন সন্তানহীনতাই যেন গৌরবের বিষয়। স্বাধীনতা শুধু নয়, দায়িত্বমুক্তি, স্বার্থপরতা ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে। ওই টেক্সচারের ভিতর ক্লান্তিও চলে আসছে। শহর বলেন, আরবানাইজড ভিলেজ বলেন, সেইসব জায়গা ইনফর্মেশন বা ইলেকট্রিসিটির জন্যই হোক, মানুষর ক্ষুদ্র জগৎও অনেক বদলে যাচ্ছে। আর্বানাইজেশন, জিনিসপত্রের দাম বাইড়ে যাওয়া, রিসোর্স কমে যাওয়া - এসবের ফলেই একটা পরিবর্তন কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গেছে। আর এইসব মানুষের চিন্তাজগতে ক্ষয় করে দিচ্ছে। একটা ছোট্ট ফ্যামিলির একই চেয়ার-টেবিল, সংসারের ২/৩ টি ফিক্সড চেহারাও তাকে ক্লান্ত করছে। অন্যত্র সরে যাওয়ার জন্য তাকে প্রণোদিত করছে। মানুষের ভিতর ইহলৌকিক অমরত্ব পাওয়ার বিষয়টা কিন্তু ইনহেরেন্ট। সে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেই পারে। বিকল্প অমরত্বের বিষয়টাও সে ভাবে।

'একটা অত্যন্ত সাধারণ বিকাল' আমার কাছে একটা খুবই ভয়াবহতম গল্প মনে হয়। আপন ভাইয়ের সামনে বোনটার সেক্সুয়েল হেরাজমেন্ট একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার মনে হয়েছে। সেই সময়কার সামাজিক বাস্তবতা কি ওইরকম ছিল?
এটা আসলে পুরা ফ্যান্টাসি ধরনের গল্প। গল্পের স্টোরিলাইনটা কিন্তু বেশি না। এই গল্পের মূল টার্গেট হলো একটা সিচুয়েশনকে প্রকাশ করা। একটা ডেস্ট্রাকশনকে যদি চিহ্নিত করতে চাই তাহলে কী করা যেতে পারে। গল্পটা হচ্ছে, ফ্যান্টাসি নিয়ে কথকতা হচ্ছে - চলো ভাবি এই রকম। এটা হচ্ছে সেইধরনের গল্প। এটা তাই রিয়েলিটির চেয়েও হার্স। কিন্তু রিয়েলিটি কি এর চেয়ে ক্রুয়েল নয়?

আচ্ছা, গল্পের আলাপসালাপের একটা সাধারণ জায়গা থেকেই আপনাকে প্রশ্নটি করা যাক, এমন কোনো গল্প কি আছে যেখানে সরাসরি আপনাকে চিহ্নিত করা যায়?
আসলে সব গল্পের ভিতরই কিন্তু আমার নিজের জিনিস আছে। আমি নিজে লিপ্ত হওয়া ছাড়া কোনো গল্পই লিখতে পারি না। কোনো না কোনোভাবে আমার একটা জায়গা তো অবশ্যই আছে।

এইখানে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই, বিষয়টা হচ্ছে গল্পের মালিকানা বলতে যে বিষয়টাকে আমরা এস্টাব্লিস্ট করি, তা কি শুধুই একজন গল্পকারের? কারণ এটা পরিষ্কার যে, আমরা এটা প্রত্যক্ষ করি - গল্পের চরিত্র, বিষয়, ভাষা, গল্পের ইতিবৃত্ত প্রকাশনা মাধ্যম, মুদ্রণযন্ত্রের প্রিভিলেজ ইত্যাদি অলরেডি আমাদের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আছে। আমি যখন একজন লেখক হিসাবেও নিজের নামটি যুক্ত করি, তখনও খানিক বিহ্বলতায় ভোগি - নিজেকে কখনও কখনও স্রেফ সংগ্রহকারী বা গল্পের সংযুক্তকারী মনে হয়।
এটা কিন্তু খুবই চমৎকার একটা প্রশ্ন। এই বিষয়টা নিয়ে আমিও খুব ভাবি। তা-ই একটা একটা করে বলি। এই ব্যাপারে আমি একদম মনে করি যে, এইগুলির মালিকানা বলতে কিছু নাই। গল্পগুলির পাঠ নিয়েই আমার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হইছে। একজন এসে বলতেছে, আমি কাছিমগালা গল্পটা তো দেড়শ বার পড়ছি। তাতে গল্পে তার একধরনের ইনভলভমেন্ট হয়ে গেল। আরও নানান জন নানান কথা বলছে। গল্পটার ব্যাপারে সেইসময়কার বন্ধুদের কথাতো আমি বলেইছি। গল্পের সাথে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাও বলা হয়েছে। তো ওই পাঠকদের ব্যাপারে বলা যায়, ওরা যখন কোনো গল্পপাঠ করে, তখন আমি ব্যক্তি হিসাবে তো থাকি না। আমারও তাই হয়, আমি যখন কারও লেখা পড়ি, তখন লেখক তো আমার কাছে থাকে না। লেখক তো নিজে বলে দেয় না যে এটা এই জিনিস। আমি কিন্তু আমার বোধ দিয়ে একটা অল্টারনেট জিনিস তৈরি করছি। কথা হচ্ছে, একটা গল্পের লেখক শুধু একজন না, লেখক তো পাঠকসহই লেখক। পাঠকও এটাকে তৈরি করতেছে। ভালো লেখাগুলোর বোধ হয় এটা একটা গুণ। আরেকটা কথা হলো স্টোরিলাইনের কথা যেটা বলছেন, ঠিক আছে, সেটা ফাইন - কিন্তু একটা জিনিস আপনার একটু মনে করতে হবে, সাহিত্যের কিন্তু নিজের কিছু জিনিস আছে যেটা লেখক হিসাবে টাইম টু টাইম করতে হয়। যেমন দেখুন ভারতচন্দ্র যখন কবিতা লিখতেছে, সেগুলি কিন্তু কবিতায় উপন্যাস। তখন কিন্তু তাকে অনেকগুলো দায়িত্ব পালন করতে হইছে। একই সাথে তাকে রাজসভা মনোনয়ন করতে হইছে। তাকে ইনফর্মেশন দিতে হইছে। তাকে বিভিন্ন ক্যারেক্টার তৈরি করতে হইছে। তাকে তার এভ্‌রিডে লাইফের স্কেচ করতে হইছে। তাকে সেসব আবার বর্ণনা করতে হইছে। একেকটা সময়ে একেকজন লেখক একেকটা দায়িত্ব পালন করেন। আমাদের এই সময়ে এসে সে অনেকগুলো মিডিয়া পাচ্ছে যার জন্য তাকে সিনেমার নাচ গান, পত্রিকার খবর, ক্যাবল টিভির ব্রেকিং নিউজ দেবার দায়িত্ব নিতে হয় না। তাহলে একটা পাঠযোগ্য গল্পের দায়িত্ব কি হতে পারে? সে এখন অনেক কিছুতে মগ্ন হতে পারে। তার জন্য এখন আরও বেশি মুক্ততা অনুভব করার সময়। তার মানে হচ্ছে, আপনি যে স্টোরিলাইনের কথা বলতেছেন, কথকতার কথা বলেন, এর সব কিছুতেই আপনি অপ্রচলিত অনেক কিছুর প্রয়োগ করতে পারেন। নতুন কিছু আনতে পারেন। এটাকে আমি ব্যবহার করতেছি, কারণ আমি তো একটা গল্প বলতে গিয়ে একটা গল্পই বলতেছি না, অনেকগুলো গল্পই বলতেছি। বলার কায়দাটাও খুজতেছি।


এটা কিন্তু অন্য সবার ক্ষেত্রেই হওয়ার কথা।
তা তো নিশ্চয়ই। আমি তো শুধু আমার কথা বলতেছি না। অন্যদের কথাও বলতেছি। সে কিন্তু জিনিস বোঝানোর কায়দা বের করছে, বৈচিত্র আনছে, এই যে সে এত জিনিস দিচ্ছে, এটা কিন্তু একটা কাজ। সে এই কাজগুলো করছে বলে গল্পকার হিসাবে তার নামটি যেতে পারে। আবার ওই কথাও ঠিক যে, পাঠক যখন গল্পটি পড়ছে তখন কিন্তু সে কিছু আবিষ্কার করছে। কারণ গল্পকার তো সেখানে নাই, সেখানে শুধু তার স্টেটমেন্টটা আছে। একজন লেখক তার সৃজনীশক্তি দিয়ে গল্পটি তৈরি করে, ডিটেইলে যায়। আবার একজন গুড-রিডারও তা করতে পারে। এখানে সময়টাও একটা ব্যাপার।

1 comment:

Anonymous said...

পড়লাম। কিন্তু নতুন লেখা কই? ব্লগ তো ঠান্ডা হৈয়া যাইতেসে!