Sunday, September 21, 2008

স্বাক্ষাতকার - 'কথা' অংশ৪

স্বাক্ষাতকার - 'কথা' লিটল ম্যাগাজিন। (৩য় অংশের পর...)


কমিউনিকেট করার সমস্যাটা এখনকার ছেলেমেয়েদের কিন্তু কম। এখন ওরা যে কোনো সমস্যাকে ট্যাকল করতে শেখে। এখন দেখবেন, অবসাদ, নিঃসঙ্গতা এইসব শব্দ বাজারে কম চালু।

এসব কেন হচ্ছে? ইন্টারনেট, সেলফোন, ইনফর্মেশন টেকনোলজির উন্নয়ন...
হ্যাঁ, অনেককিছুই এখন তাদের হাতের কাছে আছে। আমাদের স্বপ্নগুলি না-পাওয়ার যে অবসাদ, সেটা তাদের ভিতর সেইভাবে কাজ করছে না।

তার মানে এখন শিল্পের একটা সহজাত উৎকর্ষ বেশি হবে?
না সেরকমও বলা যাচ্ছে না। ওদের অন্তর্গত কষ্টগুলো কম থাকবে।

ওদের কিন্তু নির্জনতা-নিঃসঙ্গতাও নষ্ট হচ্ছে।
এটার কিন্তু দরকার ছিল। কারণ আমরা দীর্ঘসময়ব্যাপী একই রকম নি:সঙ্গ ছিলাম। ওরা নিশ্চয়ই এতো জনসংখ্যার ভিতর নির্জন হবার আনন্দটুকু সহজে ছাড়বে না।

আচ্ছা, তাহলে এই প্রসঙ্গে এটা কথা বলে নিই, আপনি কি নির্জনতা বা একাকীত্বের যে অনুসঙ্গগুলো বললেন তা আপনার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ গতকাল লাল-এ সেইভাবে বদলাতে পেরেছেন?
আমি এই ক্ষেত্রে শুধু এইটুকু বলতে পারি, নিজেকে যে বদলাতে পারে তাকে আর আলাদাভাবে সচেতন হওয়ার দরকার হয় না। ভাঙচুরের এই প্রক্রিয়ার ভিতরই তার সব হয়ে যায়।

আসুন আমরা আপনার শিল্পসত্তার অদ্ভুত এক বিস্তারের গল্প করি। আপনার কাছিমগালায় জীবনের যে বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়, তাই কিন্তু আপনার সদ্যছাপা কবিতা দাদাকাছিম ও দুটি গাছে আমরা লক্ষ করি। এটা তো শিল্পসত্তার একধরনের রূপান্তর বা এক্সটেনশন - নাকি?
সেটাও হতে পারে। পৃথিবী কিন্তু একটা জিনিসে তৈরি হয় না। এর জন্য সমুদ্র লাগে, পাহাড় লাগে। মরুভূমি বা অন্য অনেককিছু লাগে। কাজেই সবকিছু পরিপূর্ণ করতে গেলে অনেককিছুই দিতে হয়। আপনার জীবন যদি শুধু বিষাদের ভিতর দিয়েই যায়, তাহলে কোথাও না কোথাও তার ছায়া কিন্তু থেকেই যাবে।

তাহলে যাপিত জীবনের ভিতর যা-ই উপলব্ধি করেন তা-ই গল্পে আনতে চান।
তাই, মানে যা কিছু আমি তাই আমি। যেমন ধরেন, আমার খুব ঘনিষ্ঠ বয়জেষ্ঠ্য বা সমবয়সি বন্ধুদের মৃত্যু আমি দেখে ফেলছি। যতকিছুই আমরা বলি না কেন, যেই মুহূর্তে ও মারা যাচ্ছে, সেই মুহূর্ত থেকে সে কিন্তু আর একটা লেখাও লিখতে পারছে না। তার মানে এইয়ে এইভাবে বদলানোর কথা বলছি, সেটাও কিন্তু আমার জীবন। আমি যখনই আরেকটা গল্প বা কবিতা লিখতে পারছি না, তখনই কিন্তু আমি কিছুদিনের জন্য মারা যাচ্ছি। শৈল্পিক মৃত্যু যাদের হইছে তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একের ভিতর অনেকগুলো চোখ স্থাপন করা এটাই হলো বদলানো।

এবার আমি চাঁদের ব্লেড গল্পের উদয় ভানু নামের পুলিশ কর্তাব্যক্তিটির কথা বলি, সে কিন্তু আর লিখতে পারছে না। কারণ আমার মনে হয়েছে, সে তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের সীমাবদ্ধতার বাইরে আসতে পারছে না।
এটা শুধু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নয়, আসলে সে নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমরা যদি নিজেদেরকে কোনো রেজিমেন্টেশান আটকাইয়ে ফেলি, তা খাকি বা শাদাকালো বা লাল যে পোশাকই হোক বা পার্টির ফ্রেমই হোক, তাহলে কিন্তু তার পক্ষে ফৃ শিল্পচর্চা করা মুশকিল।

আমি আপনার বিষয়গুলো ক্লিয়ার করে ধরতে পারছি না। তাহলে যৌথচৈতন্যের বিকাশটা কিভাবে হবে?
ওই যে বলছিলাম, যৌথঅবদমন থেকে যখন আমরা বেরিয়ে আসতে পারব, তখনই ওই চৈতন্যেরও বিকাশ ঘটবে।

আচ্ছা, তাহলে রাষ্ট্র সম্পর্কে আপনি কেমন আকাঙ্ক্ষা লালন করেন? সেখানকার মানুষজন, প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, মিলিটারি কেমন হবে?
এখানে দুইটা জিনিস আছে, এই সময়ে বসে রাষ্ট্রহীন পৃথিবী কল্পনা করা মুশকিল। আর হচ্ছে, ইহজাগতিকতার ভিতর অমরত্বের বিষয়টা সার্বিকভাবে এভাবে জাগিয়ে রাখতে হয়। মানুষ কখনই সমস্ত কিছু পাওয়ার পরও সন্তুষ্ট হবে না। মানুষের আল্টিমেট আনন্দের কোনো জায়গা নাই। মানুষ আনন্দের ভিতরও দুঃখ বা অবসাদের জায়গাগুলি থাকবে। এটা বোধ হয় মানুষের জিনের একটা ব্যাপার।

আচ্ছা, তাহলে আপনি বলুন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন, ধর্ম বা ঈশ্বরের সাথে আপনার বোঝাপড়াটা কেমন?
ধর্মের কিন্তু এক চেহারা নেই, টাইম টু টাইম এর চেহারার বদল হয়। যেমন ধরুন, একপক্ষ বলছে, এর কোনো কার্যকারিতা নেই। অন্যপক্ষ বলছে, এটাই বারবার কার্যকর হয়ে আসছে। ধর্ম নানান সময়ে নানান কাজ কিন্তু করছে। একই সময় সে দর্শনের প্রভুত্ব দেয়, আবার মনস্তাত্বিক বা সামাজিক শৃঙ্খলার নির্দেশনা দেয়। সে একটা কর্পোরেট এমবিএ’র মতো সবকিছু জোড়া দিয়ে দিয়ে করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিন্তু বিভিন্ন যায়গা থেকে ভাল ভাল জিনিস নিয়ে একটা কিছু করে। অর্থাৎ বিজ্ঞান যে জিনিসগুলো খুঁজে বের করে, অর্থনীতি যার রহস্য জেনে যায়, মনস্তত্ব যে কৌশলের কথা বলে, চলমান ধর্ম কিন্তু তা ধার করেই তার নির্দেশনা গুলি তৈরী করছে। তারপর সে তার ব্র্যাণ্ড লাগাচ্ছে। সমস্যা এই ব্যাণ্ডিং এর। আমি যদি চাই লাল রঙের কাগজ তো সাদা রঙের ফেরিঅলা এসে আমাকে জোর করে তা কেনাচ্ছে। আমার কাগজ না লাগলেও তা কিনতে হবে। এখানেই ঝামেলা হচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যখন পাওয়ার পলিটিক্সের সাথে পাল্লা দিচ্ছে, তখন সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে ক্ষমতাহীন মানুষদের। লোকাচারের জিনিসগুলো ধর্ম কখনও কখনও নিয়ে নিচ্ছে। এবং সে তা প্যাকেটজাত করছে। আমাদের লালন নিজের মতো করে ব্যক্তিগত অর্জন, ব্যর্থতা, বিশ্বাস নিয়ে মানুষের মনের মধ্যে যাচ্ছে, কি দরকারীই না হয়ে উঠেছে। তার জন্য তো কোন ব্র্যাণ্ডিং দরকার হয় নাই। কি হবে আর বলে, এই দেখো লালন কিন্তু মুসলিম বা অন্যরা যদি বলে, লালন মুসলিম হলেও হতে পারে, কিন্তু তার জন্ম তো হিন্দুঘরে বা কেউ যদি বলে, না, সে ছিল সুফিবাদী। আসলে সে কিন্তু নিজের জীবনযাপন, নিজের অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদি দিয়ে তার নিজস্ব জিনিস তৈরি করছে। যা নিজস্ব আবার সবার। কারণ মানুষ তো সমবেত ভাবেই যায়। সে কিন্তু নিজে একা কিছু করার কোনো ব্যাপার না। দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটা আসলে ওই জায়গাটাই, কথা হচ্ছে, দেয়া-নেয়ার এই ব্যাপারটা আমার ক্লিয়ার থাকা দরকার। একজন ধর্মের লোক যখন মানববোমা হচ্ছে, তখন কিন্তু সে নিজেকে তার প্রভুর কাছে উৎসর্গ করছে না, সে একটা রাজনৈতিক শক্তিকেই তা উৎসর্গ করছে। কারন প্রভুর কাছে উৎসর্গ করতে বোমা নয়, একটু ধ্যানই যথেষ্ট। এই জিনিসটা আমাদের বুঝতে হবে। এই জিনিসটা যদি বুঝি তাহলে নেয়া-দেয়ার ব্যাপারটাও পরিষ্কার হবে।

ঠিক আছে, এবার আপনার গল্প নিয়েই ফের কথা বলি। আপনার গল্পগুলির ভিতর বাসেত হিরনচি অত্যন্ত প্রিয় এবং সমকালের ভয়াবহ বাস্তবতার এক নিগূঢ় চ্ছবি। আপনি এর বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
একটা বিষয় তো সত্যি যে, আমি আনঅর্থোডক্স প্রসেস খুব পছন্দ করি। আমি নিজে কিন্তু বৈচিত্রময় জীবনযাপন করে থাকি।

এখনও আপনি তাই করেন?
তা বলতে পারেন। এই গল্পটি যখন লিখি তখন কিন্তু হিরনচিদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। দিনটা শুরু হয়তো পাঁচতারা হোটেলে অফিস করে, আবার রাতটা ওদের সাথে। যেমন, ইদানীং একটা বিষয় খেয়াল করছি, রাস্তা দিয়ে চলার সময় অনেকেই দেখবেন চরম উদাসীন, কে আসলো কে গেল কোনোই খেয়াল নাই। আমি কিন্তু লোকজনের মুখের দিকে তাকাই। আমি ভাবি, আচ্ছা, আমি এই কাজটা কেন করি! আমি কি কাউকে খুঁজি? এই তো গতবছর আমার ঘনিষ্ট একটা বন্ধু মারা গেছে। তার সাথে একেবারে বালককাল থেকে দীর্ঘসময় একসাথে আমার কাটছে। তার জীবন ছিল খুবই বর্ণাঢ্য, সে সামরিক অফিসার ছিল, নিজেও একটা আনঅর্থোডক্স লোক আর-কি। যখন যেটা করা দরকার সেটাও করত, আবার উল্টাটাও করত। তো হয়েছে কি, ও মারা যাওয়ার পরে একদিন দেখি কি ও আমার সামনের রিক্সায় করে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে ওর রিক্সাটার কাছে যাবার আগে আমি জ্যামে আটকাইয়া গেলাম। ও কোথায় যেন চলে গেল। আবারও ওকে আমি বিভিন্ন জায়গায় দেখতেছি। আমার মনে হচ্ছে, মৃত্যুটা কি বাসা বদল। মানে ও হয়ত মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরায় গিয়ে থাকতেছে। বাসেত-কে আমি চিনতাম। ওর ঘরে গেছি। ওর অনেক কথাই বলা বাকি আছে। যদিও ওর প্রথম বউ এখন খুব ভাল আছে, কিন্তু কবরে নিশ্চই ওর হাড়গোড়গুলিও আর আগের জায়গায় নাই।

No comments: