Sunday, September 21, 2008

স্বাক্ষাতকার - 'কথা' অংশ৩

স্বাক্ষাতকার - 'কথা' লিটল ম্যাগাজিন। (২য় অংশের পর...)

ওই ছোটকাগজটার কি নাম নাম ছিল?
মনুমেন্ট।


তখন ওইটাকে কি শুধু কিশোরগঞ্জে অবস্থানকারী সব লেখক ছিল।
না না, ওইটাতে আবিদ আজাদ বা অন্যান্যদের লেখাও ছিল। কাগজটি বের করার পর দেখা গেল লোকজন আমার বন্ধুকে আর খোঁজে না, খোঁজে আমাকে। এই একটা মাত্র ভুলে আমি সম্পাদক হয়ে গেলাম। আমি আসলে কিন্তু তখন একজন বিজ্ঞানী । তখন বন্ধুদের নিয়ে বিজ্ঞান প্রজেক্ট করি। তবে ফরিদপুরে আমার একবন্ধু ছিল, ও ছিল কবি। ওর কথা খুব মনে পড়ে। ওর নাম ছিল খোসবু। ও প্রতিদিন কবিতা লিখত। ওর জীবনটা ছিল নজরুলের মতো। ও এক আত্মীয়ের বাসায় থাকত। তবে ওর কবিতা লেখা সেখানে পাত্তা পেত না। একসময় বাসায় জায়গা নেই বলে ওকে মসজিদে থাকতে হতো। মসজিদের ভিতর লুকায়ে লুকায়ে সে তার বইগুলো পড়ত। আমি তখন বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাপার-স্যাপার, এডভেঞ্চার ইত্যাদি পড়তাম। আমাদের বন্ধু ছিল একজন বৃদ্ধ দরজী। তো ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময় একবন্ধুকে পেয়েছিলাম যে কবিতা লিখত আর ৯ ক্লাশে থাকতে পেলাম আর এক বন্ধুকে, যে গল্প লিখত। যখন আমার মনে হত, এইসব আর এমনকি, আমি তো বিজ্ঞানী, অন্য লাইনের লোক। ওরা আসলে না পড়েই লিখত, ওদের ইমোশনটাই ছিল মুখ্য। তবে এখন মনে হয় ওরাই আমাকে কবিতা আর গদ্যের প্রথম পাঠ দিয়েছে।


আচ্ছা, আমাদের তো কথা হচ্ছিলো কবিতা আর গল্পের পার্থক্য নিয়ে। আমি আমার প্রথম কাব্যসাধনার কথা বলি, তখন একটা কবিতা লেখা আমার কাছে রীতিমতো প্রজেক্ট টাইপের ব্যাপার ছিল। তবে গল্পটাকে মনে করতাম কবিতার ফাঁকে-ফাঁকে একটা কিছু। আমি গল্পলেখার শুরুতে অন্যদের নিয়ে গল্প লিখলাম। কিন্তু ৮৫ তে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ কাছিমগালার প্রথম গল্প প্রথম কবিতা লিখতে গিয়ে আমি রীতিমতো অন্যরকম হয়ে গেলাম। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমাদের গ্রুপটা ছিল যারা এত দিন ভালো ছাত্রত্বের মধ্যে থাকতে থাকতে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে চায় অন্যত্র তাদের নিয়ে। ওইখানকার একাডেমিকরা আমাদের খুব বেশি ইমেপ্রস করতে পারে নাই। আর তখন দেশে ঘনঘন সামরিক থাবা সব কিছুকে গোলমেলে করে দিচ্ছিল। তখন জীবনকে ডেঞ্জারাস করার দিকেই ঝুঁকে পড়লাম। ওইসময় আমি সত্যিকারের কিছু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হই। এর ভিতর সম্পর্কের একটা জটিলতা ছিল। আমি তখন বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা-টাড্ডা দিতাম। ফকির-বাউলদের বৈঠকে যেতাম - কখনও দলবদ্ধভাবে, কখনও-বা একা। তখন ঐ আড্ডায় বসে বসে টুকরা টুকরা গদ্য লিখতাম। হয়ত জার্নাল লিখতে চেয়েছিলাম। তো একদিন চয়ন খায়রুল হাবিব বললো (১৯৮৫) ও একটা কাগজ করতে চায়, গদ্যের। আমিও ভাবলাম ছাপবো নাকি এই গদ্যটা? জলপ্রপাত এ ছাপা হল - প্রথম কবিতা। ছাপা হবার পর বুঝতে পারলাম হ্যাঁ আমার মন মতো হয়েছে এটা।

এবার নিজের সাইকোলজি সম্পর্কে কিছু বলুন।
একটা ব্যাপার হচ্ছে, কোনো কিছু থেকে আমি নিজেকে সরায়ে নিতে পারি। যেমন, ধরেন আবৃত্তি/পেন্টিং করলাম কিছুদিন, আবার এসব থেকে আমি নিজেকে হঠাৎ সরায়েও নিলাম। আমার ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এমনও হয়েছে যে, নিজেকে নিরাপদ অবস্থান থেকে সরায়ে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। বারবার নিচ্ছি। এটা ঠিক কেন, তা হয়ত পরে বিস্তারিত বোঝা যাবে। এবার মনস্তত্বের দিকে যাচ্ছি না। শুধু বলতে চাই আমি নিজেকে আসলে বদলাইতে থাকার মধ্যেই রাখতে চাই।

সেটা শিল্পসাহিত্যের জন্যও দরকার?
হ্যাঁ। সরায়ে ফেলতে হয়, তা না হলে এত বিষয় নিয়ে কিভাবে আপনি লিখবেন। একটা বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলে আপনি তো আত্মপ্রেমী হয়ে গেলেন।

ঠিক আছে, আপনার পুর্বের কথা রেশ ধরেই বলছি, সত্যিকারের বিপর্যয়টা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা যাবে কি?
না সবকিছু বলা যাবে না, পরে বলব আর-কি হাহাহা। সেভেন্টি সেভেন থেকে আমার ডায়েরিগুলো আছে। তাতে একদম খোলামেলা সব লেখা আছে। তবে এটা স্বীকার করতে হবে আমার খুব নিঃসঙ্গতা ছিল। আর আমি মনে করি, এটা আমাদের ভিতর খুবই কমন বিষয়। আসলে যাদের সিক্সটি বা সেভেন্টিতে জন্ম এবং এইটিজে যারা তাদের কৈশোর গেল, যারা অফুরন্ত স্বপ্নের কথা, সম্ভাবনার কথা শুনল, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধের বেদনা তাদের বেশি কষ্ট দিল। তখন আমি মনে করতাম আমিই সবচেয়ে দুঃখী। কিন্তু পরে বুঝলাম যে এটা আমার সময়ের একটা দুঃখ। আমি খুঁজে খুঁজে সেরকম পাঠ করে ফেললাম যাদের এই ব্যাপারগুলোর সমর্থন আছে। এটাকে সবাই তো আর ক্রিয়েটিভিটির দিকে ট্রান্সফার করতে পারে না। সামগ্রিক কষ্ট যে খুব ফেলনা জিনিস না, সেটাই আমি তখন অনুভব করি। এর তো পজেটিভ সম্ভাবনা থাকে। এখন আমাদের যদি কোনো পজেটিভ বলার জায়গা থাকে তাহলে সেটাই - মানে বলা যায় যে, দেখো, আমরা কিন্তু প্রচুর কষ্ট করছি। এত কষ্ট করছি যে, আমাদের এখন সেই কষ্টের অবসান হওয়া উচিৎ। এই যে আপনি ঘুরেফিরে পলেটিকাল কন্সাসনেসের কথা বলেন, দেখেন, আমাদেরকে বিন্দুমাত্র সময় কি গেছে যেখানে পাকিস্তানের প্রব্লেমের সাথে সাথে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের বিষয় নিয়ে কষ্ট পাই নাই, কি পারিবারিক ভাবে, কি ব্যক্তিগত ভাবে!

সেটা তো আছেই, মানুষ তার বেসিক রাইট নিয়ে ভাববেই।
হ্যাঁ, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বড়ো আকর্ষণ কিন্তু ছিল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সমাধান।

এবার আপনার গল্পলেখার ধরন সম্পর্কে কিছু কথা জানার বাসনা রাখি। আচ্ছা, আপনার গল্পে একধরনের কথনভঙ্গি কিন্তু আছে। তা কি স্বত:স্ফূর্তভাবে করেন নাকি এটা আপনার একটা সচেতন স্টাইল?
এটা কিন্তু একটা মজার ব্যাপার, আর আমি এটা নিয়েও ভাবছি। আমি যেটা ইতিমধ্যে বলেছি, নিজেকে ভাঙবার আগ পর্যন্ত নিজেকে আমি একজন পাঠক হিসাবে তৈরি করি আর দেখি যে আসলে আমি কারও সাথে ভাবের লেনদেন করতে পারছি না। আমার স্বাভাবিক মুখচোরা স্বভাব ছিল, অচেনা লোকতো বটেই অতিচেনা লোকের সাথেও কথাসূত্রে কমিউনিকেট করতে পারতাম না। এটা কিন্তু সামাজিক অবস্থারই একটা কারণ। আমি বলি কি, দীর্ঘঅবদমন কিন্তু আমাদের এই জাতির উপর দিয়ে গেছে। আমার কাছে মনে হয় কি, গত কয়েকশ বছরের ইতিহাস হলো আমাদের অবদমনের ইতিহাস। যৌথচৈতন্যের ভিতর ধারাবাহিক অবদমন ঘটছে, এসবের চিহ্ণ সংস্কৃতির বিভিন্ন পকেটে এখনও দেখা যায়। আপনি যে পলিটিকাল যৌথউত্থানের কথা বলেন, তা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যক্তিগতভাবে আমি যোগাযোগের বিষয়গুলো ভাঙ্গি। আমি এর জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী বা গ্রুপের শরণাপন্ন হই। বাউল-সন্ন্যাসী বা খামখেয়ালিতে ভরপুর মানুষজনের কাছে আমি যাই। আনঅর্থোডক্স যে জিনিসগুলো আছে, সেসবই কিন্তু অবদমন কাটানোর একটা পথ। আমি কিন্তু প্রচুর সময়, বিভিন্ন রকম করে ওদের সাথে কাটাইছি। আমি জানি, আমি শহুরে জীবনে ওইরকম না, তবু জোর করে আমি ওইখানে গেছি। এইভাবে ভাঙাটাই আমার ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে। এটা নিজের ক্ষমতাকে বোঝার জন্যও দরকার। যাই হোক এইসব করতে গিয়ে হয়ত আমার একটা কথন তৈরী হয়েছে, তবে এ বিষয়ে আপনারাই ভাল বলতে পারবেন!


কমিউনিকেট করার সমস্যাটা এখনকার ছেলেমেয়েদের কিন্তু কম হয়। এখন ওরা যে কোনো সমস্যাকে ট্যাকল করতে শেখে। এখন দেখবেন, অবসাদ, নিঃসঙ্গতা এইসব শব্দ বাজারে কম চালু।

No comments: