Sunday, September 21, 2008

স্বাক্ষাতকার - 'কথা' লিটল ম্যাগাজিন অংশ১




প্রকাশিত হয়েছে: কথা, ৫ম সংখ্যা, চৈত্র ১৪১৪/এপ্রিল ২০০৮
সম্পাদক: কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, রেলওয়ে হাসপাতাল (অন্তর্বিভাগ), সিআরবি, চট্টগ্রাম-৪০০০
ই-মেইল: editorkatha@yahoo.com
কাজল শাহনেওয়াজের সাথে কথাবিনিময়

আমরা আমাদের আলোচনার শুরুতেই আপনার শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
আসলে এ সম্পর্কে আমি খুব একটা বলতে চাই না। কারণ যতটুকু এ নিয়ে লেখা যায়, ততটুকু আসলে বলা যাবে না। আমার বাবা সরকারি চাকুরি করতেন - তিনি ছিলেন ভ্যাটেরেনারি সার্জন। তাঁর চাকুরিসূত্রে আমাকেও নানান জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। যার ফলে আমার দেশ বলতে সারা দেশটাই আমার দেশ। আর বন্ধু বলতে সব জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো আমার বন্ধুসকল। আমার শৈশব অনেকটা চরভাঙা মানুষের মতো।


আপনার গ্রামের বাড়ি তো বিক্রমপুর?
বিক্রমপুরে তো আমার দাদার বাড়ি - সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছাড়া আমি সেখানে থাকিনি।


আচ্ছা ঠিক আছে - কিন্তু কথা হচ্ছে একাত্তরের সেই যুদ্ধের সময়টা সেখানে তো ছিলেন। সেই সময়ের টোটাল ফিলিংসটা সম্পর্কে কিছু বলুন।
হ্যাঁ, এই বিষয়টা আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই সময়টা সম্পর্কে কোথাও কিছু বলি নাই। তবে এই সম্পর্কে আমি বিস্তারিত কিছু বলতে চাই - কারণ এটা আমার জন্য এত বেশি আলোড়িত করার জিনিস, তা নিয়ে কিন্তু মহাপরিকল্পনা নিয়ে বসে আছি। এটা আমার ভিতরে খুব কাজ করে। এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলি - কিছু আগেই আমি মাহমুদুল হকের মাটির জাহাজ পড়ছিলাম। তো, সেখানে বিক্রমপুর, একাত্তর/বাহাত্তর আছে- যাই হোক। সেই বইটা পড়েই আমি আমার একাত্তর পুনরায় বোঝার চেষ্টা করলাম। তখন আমার বয়স কত হবে? এই ধরুন, ১০ বছর। আমি কিন্তু তখন অনেক কিছুই বুঝি। ওই জায়গাটা তো তখন ছিল দুর্ভেদ্য এলাকা। চারদিকে নদী - যার ফলে যোগাযোগ ছিল পানি পথে। আমি বাবার সাথে যেখানে ছিলাম সেটা কিন্তু এপ্রিলেই আক্রান্ত হয়ে গেছে। তখন আমরা ছিলাম ফরিদপুরে, সেই সময় আমরা পোটলাপুটলিসহ বিক্রমপুরে চলে আসি। বাবা তখন ফরিদপুর-বিক্রমপুর আসা-যাওয়া করতেন। আর আমি তার আগেই ৬৯-এর মিছিল দেখে ফেলেছি আর-কি। এই মিছিলে যাওয়াটা কিন্তু তখন সবার মধ্যে। আবার বাবা তো সরকারি চাকুরে, যার ফলে যারা মিছিল করত তারা কিন্তু আমাদের বাসার দিকে ঢিল মারত। এটা কিন্তু একধরনের মজার ব্যাপার ছিল - একই সাথে আমরা দুইটা দিকই দেখছি। আর সেই মিছিল, মানুষজন, শ্লোগান - এসব তো এখনও আমার মনে জ্বলজ্বল করছে। হ্যাঁ যা বলছিলাম, একাত্তরের সেই সময় হঠাৎ একদিন গুলির শব্দ শুনলাম, মানুষজন দলে দলে পালাচ্ছে। তখন বয়সের কারণেই হোক, আর যে জন্যই হোক, এইসব ব্যাপারে আমার ছিল দারুণ কৌতুহল। আপনাকে একটা সকালের কথা বলি। সেই সকালে পাকিস্তানি মিলিটারিরা একটা বাজারে এসে আগুন দিল। ফরিদপুরের সেই জায়গাটা ছিল হিন্দু অধ্যুসিত। যার ফলে আর্মিদের আগ্রহটাও ছিল। ওরা পুরা প্যানিক তৈরি করতে যাচ্ছিলো তো। আমি কিন্তু বালকের নির্ভয়ে ১২টার দিকে পুড়ে যাওয়া বাজার দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমি তখন যে পাগলটাকে চিনতাম, সে সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে। এটা একটা সাংঘাতিক দৃশ্য ছিল আমার জন্য। আমার এখনও মনে হয়, একটা দারুন বিভতসতা তখনই আমি দেখে ফেলছি।


আমরা যেহেতু সরকারি বাসায় ছিলাম, যার ফলে আর্মিদের সাথেও ইশারায় আমাদের কথা হইতো। কিন্তু ওদের মানুষ বলে মনে হতো না। আরেকটা ঘটনার কথা বলি, তখন মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। তারা সেইখানকার থানা এ্যাটাক করল। সারারাত চারদিকে গুলির শব্দ। সকালে যুদ্ধ থেমে গেলে আমরা গুলির খোসা কুড়াতে গেলাম। তাতে আমরা সেই যুদ্ধের জায়গাটাও দেখলাম। তখন কিন্তু আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে একটা বড় যুদ্ধ হচ্ছে এবং তাতে আমরাও একটা পক্ষ। প্রথম দিকে এটা ছিল একটা খেলা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর সবদিকেই সাজসাজ রব শুরু হয়ে গেল। আমাদের স্কুলের মাঠে কে একজন লোক যার যা আছে তাই দিয়ে প্রতিরোধ ট্রেনিং দিতে লাগল। আমরা বালকেরাও ট্রেনিংয়ের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যেতাম। তখন এসব আমাদের খেরার অংশ। কিন্তু আর্মিরা যখন অনেক মানুষ মেরে ফেলল, তখন কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল।


তো, যা বলছিলাম, মুক্তিযোদ্ধারা যখন থানা আক্রমণ করল, তখন দেখলাম আমাদের চেনাজানা ওসি আহত হয়ে কাতরাচ্ছে। তখন কিন্তু আমার খারাপ লাগল। কারণ সে তো চেনাজানা একজন মানুষ। সেই পাগলটা দেখে খারাপ লেগেছিল, আবার এই ওসিকে দেখেও খুব খারাপ লাগল। আমরা সবাই খুব কাঁদ কাঁদ হয়ে গেলাম। মায়েরা তাকে সেবা-শুশ্রূষা করলো একজন মানুষ হিসাবে। এইভাবেই আমার মনে হয় কি, যুদ্ধটাকে অনেকভাবে দেখার আছে।


তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের একটা কমিটমেন্টের ব্যাপার তো আছে?
আমি ঘটনাসমূহই বলি, তাতেই আমার দৃষ্টিভঙ্গিটাও ক্লিয়ার হবে। আমরা কিন্তু বেশী দিন ওভাবে থাকতে পারলাম না। কারণ কেউ ভরসা পাচ্ছিল না পাকিস্তানিদের নানামুখী অত্যাচারের কথা শুনে। আমাদেরকে দাদার বাড়ি বিক্রমপুরে চলে আসতে হলো। আমরা কার্যত সেখানে স্থবির হয়ে গেলাম। স্কুল নাই, বাইরে যাওয়া নাই। গেরিলা যুদ্ধ ক্রমশ: বাড়তে থাকল। আরেকটা বিষয় হলো, ঐ এলাকাটা সিরাজ শিকদার বাহিনীর জায়গা হওয়াতে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের টাইপটাও ছিল অন্যরকম। মুক্তিযোদ্ধারা লৌহজং থানা দখল করেছে এবং সেটা পুড়ায়ে ফেলছে। আমার মনে আছে, আমাদের চাচারা সেখানে গেছে এবং পোড়া কয়লা নিয়ে এসে বলছে, আমরা এই কয়লা নিয়ে দাঁত মাজবো। তাহলে বোঝেন সবার কত খুশি। যুদ্ধের ভিতর কিন্তু বলতে গেলে সব পরিবারই পড়েছে। পলিটিকাল প্রসেস যাই হোক, এতে কিন্তু সব মানুষ ইনভলভ হয়ে গেছিলো, সবাই স্বপ্ন দেখছিল। যুদ্ধ করছিল। জয় পরাজয় নিয়ে ভাবছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছিল। বিশাল আলোড়ন ঘটে যাচ্ছিল। এটা ছোটোখাটো কিছু ছিল না। এটা পুরো জাতির অস্তিত্বের বিষয় ছিল, ছিল একটা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।


হ্যাঁ, একটা পরিবর্তনের বিষয় নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মানুষের জাগরণের সাথে সাথে বিভিন্ন বামদল ও গ্রুপের যে উত্থানটা হলো তাতে রাষ্ট্রীয় নীতির ধরনে কি আপনাকে আশান্বিত বা হতচকিত করেছে?
দেখুন, এর পরে-টরে কিছু নাই; তখন আমার বয়স ১০ বছর ছিল, এখন আমি ৩৫ বছর ধরে দেখছি - আমার অবজার্ভেশনটা হলো এরকম, যারা ক্ষমতা নিয়ে প্লে করছে, মানে যারা পাওয়ার উইনার, তারা প্রতিটি জিনিসকে কিন্তু একটা যুদ্ধ অবস্থার মইধ্যেই রাখতে চাচ্ছে। সবাইকে সর্বদাই সন্ত্রস্ত হয়েই থাকতে হচ্ছে। ক্ষমতার মূল বিষয় মনে হচ্ছে, মানুষজনকে ক্রমাগত সংকটের মইধ্যে রাখতে হবে। যেন সন্ত্রস্ত করে রাখলেই মেজোরিটি মানুষ ক্ষমতাকে ভয় পাবে, কাছে আসতে পারবে না। নিজেকে সেইফ করতে-করতেই তার সময় চইলা যাবে। বড় কিছু করার দিকে সে আসতেই পারবে না। পুরা পৃথিবীর ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার এটা একটা চাল ও বটে। আসল কথা হচ্ছে, কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধ তৈরি করে রাখা। সেটা আমেরিকার ইরাকে গিয়েও হইতে পারে কিংবা বাংলাদেশে উইনি গেম খেলে ও হতে পারে। এটাই এখন পাওয়ারের প্রিয় পদ্ধতি।

[২য় অংশ...]

No comments: