Friday, April 23, 2010

প্রকাশিত গল্প: নমরুদের তীর

‘আলী, চা!’
 
      ম.আলী চা আনে, দীর্ঘ শরীর টলটলে, চা’র কাপ ম্যাজিকের মতো নিয়ে আসে। মধ্যরাতের প্রাচীন ঘন্টা বাজে ইলেক্ট্রনিক্সে। ‘দাও, চা, সিগারেট।’ ঘন্টাধ্বনি টুং টাং, এই পর্যন্তই, কুহক বাজে না। কুহক বাজে না। কোথাও কুহক নেই বলে; তাও নয়, কুহক দরকার নেই। দরকার সময়। চাকার নিচে পিসে যাওয়া চামড়ার বল, ল্যাপটানো টিন রঙের সময়। চিৎ ও অনড়।

    অফিস ঘরে অসংখ্য জানালা, ঘিয়ে পর্দায় চাপা ফুলের রং লাগানো। একপাশে চারতলা লালবাড়ি, ঝুলবারান্দাগুলো বুকে ধরে রাখে কিশোরী মেয়ে পুরুষ শিশু - নানা রঙের কাপড়গুলি। কোনোটা ছড়ানো, কোনোটা ঝুলানো - মেলে দেওয়া, ফেলে রাখা - দু একটা উড়ন্ত। কখনো শাদা হাত সেই গৃহগুলির গ্রীলে - শব্দ নেই, দৃষ্টি নেই, পর্দা ছটফট করে বাতাস এলেই।

    প্রবেশ পথের গলার কাছে অন্ননালী আর শ্বাসপথ। শ্বাসপথটি বায়ে গিয়ে মিশেছে বিবাহ নিবন্ধকের কার্যালয়ে। অন্ননালী, প্রাইভেট নির্বিশেষ সাধারণ গেটে। পেতলের ঝকমকে অরে প্রতিষ্ঠানের নাম আঁকা। তিনটি অক্ষরের।

    বাঁ দিকের রাস্তাটির সাথে, বা যার দেয়াল ঘেঁষে রাস্তাটি, এমেরিকানদের প্রবাসী গুদামঘর, দামী, চুনসাদা প্লাস্টিক পেন্টে ছোপানো বিশাল এলাকা। ঝক করে জ্বলে ওঠে বিদ্যুৎহীনরাতে বজ্রের ডাকে। নিয়মিত পারদবাষ্পের নীলচে আভায় প্লাবিত ঘাসগুলো গৌরবহারা পলিথিন।

    চল্লিশ পার হলেও অফিসের এই ছাদের নিচে বসে বাদামী চোখের ইন্তিখাব বুঝতে পারেন না কেনো দিনগুলোকে গালিয়ে ফেলতে হয় দৈনিক তার চল্লিশটা সিগারেটে; বস সিগারেট - সস্তা ফিল্টার; আগুনের জন্য পুরো দেশলাইয়ের সবগুলো কাঠিই পোড়াতে হয়।

    এই বয়সে এটা একটা দারুণ পাওয়া বটে। আগুনের কি যে সুখ। দুদিন না যেতেই গিজগিজকরা রূপালী চুমকি মেশানো দাড়ি গোঁপ দিগগজ হয়ে ওঠে। এটা নাকি ক্ষয়ের চিহ্ন; যৌন অবসাদ। লিঙ্গ কুঁকড়ে যেতে থাকার সংকেত।

    ‘বুঝলেন, এই ম্যাপ ট্যাপে কিছু হবে না, এ দেশের জন্য দরকার কেজো বায়োটেকের সমাধান।’

    ‘কি সাহেব সমুদ্র অভিযানের কতদূর? ভয়েজ ফর দ্য আনফাউন্ড মিরাক্যাল।’

    বিশাল ফরমিকা টেবলে কন্টুর ম্যাপের অসংখ্য ছোট টুকরা জোড়া দিতে দিতে গলদঘর্ম প্রকৌশলী তরুণদের বলেন। তার কন্ঠে সক্রেটিসের চালাকি নেই, বাবুল সর্দারের ভাড়ামো নেই, অষুধ বিক্রেতার উপরসাধুতা - কোনো কিছুই নেই। নিরঞ্জন নয়। করুণ, ব্যথাতুর আর্তি। ‘বুঝলেন, ধান চাষ বাদ দিতে হবে। শামুক শালুকের চাষ দরকার। ঝিনুকের চাষ। সবই খেতে হবে। নিজেদের পাঙ্গাস, মাশরুম, ব্যাং, জলঢোঁড়া, হরিয়াল, শুশুক, কচু, সারস, কাছিম, তেলাপিয়া, ঝোলাগুড়, সিঁদল, হর্তুকী, কুমীর, কেঁচো, কুঁকড়া, বাংগী, ঝিংগা, ভ্রূণ হওয়া সাপের ডিম, টিকটিকি, শুটকি, মুটকি শুয়োর, হাড়গিলার বাচ্চা, বাঁশের কোড়ল - যা মন চাইবে, জিভে সুরসুরি তুলবে, পাকস্থলী গলাতে পারবে, তাই খাদ্য।’ বাদামী চোখ পরিকল্পনার সম্মানে চকচক করে। হাতে ব্যর্থ সিগারেট, গৌর বর্ণের চিবুক, নীল ফুলস্লীভ চেক ফানেলের সার্ট এই চৈত্রেও, কি যেন কি জন্য। বছরভোর হাত ঢাকা কাপড়; বেল্ট এঁটে দাঁড়ালে যদিও আজ আশায় মন দুলে ওঠে, বিপ্লবী মনে হয়। মুজিব, জিয়া বা এরশাদ বিরোধীতাসহ।

    আবছারের মাথায় বিরল কেশের সৌন্দর্য। খুলির গঠন অস্ট্রেলয়েড, আর চোয়াল মোঙ্গলয়েড হে। টিমটিমে চোখে মানুষের হাসিকান্না, বিড়ালবিষাদ মাপে সাবধানে। আর হুংকার দিতে গিয়ে এমন সব গালি দেয় বা হেসে হেসে কাশি আলগা করে যে সহজেই নাম রাখা যায বাঘা বিড়াল। বর্তমানের বেচারা সাজে না। সারাণ ক্ষীনশক্তি বান্ধবভাব। চোখ উল্টে কপালের ওপর দিয়ে পিছনটা দেখার জন্য চর্চা করেছে। মন্থর দুপুরাহ্নে একথা বলে গদি মোড়া চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছুণ হাঁপায়। কে বলে এই লোক একদিন শ্রেণীশত্রু সাবাড়ের জন্য মানুষ খতম করে টুকরো টুকরো কেটে গরুকে খাইয়ে মৃতদেহ লোপাট করেছিলেন। জীবনের সব গল্প সাদা করে রেখেছেন। ছবিহীন পাসপোর্ট ব্যাটা।

    একদা যৌবন ছিলো চিংড়ির রক্ত, আল্লার আরশকে নমরুদের তীর হতে রার ছলে ফেরেশতারা পৃথিবী থেকে সেই রক্ত তুলে নিয়েছে।

    সানজুর হঠাৎ ঢ্যাঙা হয়ে যাওয়া শরীর রক্তহীন, সেই রকমই ফ্যাকাশে গাল। ওর থেকে খর্ব পুরুষ দেখলেই ভয় পায়, এই বুঝি লোকটা ধমকে জিজ্ঞেস করবে, ‘এত লম্বা হলে কেন, অ্যাঁ!’  পাঁচ-নয় এর সরু একলা সুপারী গাছ। টেবিলে কুঁজো হয়ে কাজ করতে হয়। এই অফিসে কেমন একটা বাড়ি বাড়ি ভাব, এ জন্য আরও যন্ত্রণা। পৃথিবীর কেউ যদি কাউকে না জানতো। নির্মাণবিক যান্ত্রিক বাস্তবতা ওর জন্য চমৎকার। ভীড় পছন্দ, ভীড়ই ভাল, এ জীবনে ভীড়হীন একা হওয়ার বন্দোবস্ত নেই। এক নয় একাকার হওয়া স্বপ্নে মাথা ধরে। ওর হাতব্যাগ ভর্তি নীল, হলুদ, লেমনগ্রীন নিউরন রক্ষাকারী টেবলেট কতোরকম। একা না হওয়ার যন্ত্রণা খলবল করে।

    মিনাকরা দাঁত চেপে হাতব্যাগ খুলতে খুলতে তাহমিনা বলে, ‘একটা চমক দেয়া যাক’ - বলে নিম্নপদস্থদের স্কিপ করে উপরের সবার টেবলে কাঠচাঁপা রেখে আসে। গন্ধ সবার কাছে অচেনা - ফুলটি ততোধিক। আসলে এ দেশের মানুষ ফুল ভুলে গেছে। ভিতরে ভিতরে অবাক হয়েছে ওরা, বাইরে থেকে অবশ্য বুঝতে পারা যায়না। ভেতরের টান অন্য কোথাও, পোশাকের সেলাইয়ের কাছে। তাহমিনা ফুলগুলো টেবলে রাখতে রাখতে সেই লোকটির দিকে বিনীতভাবে তাকায়। সবার চোখেই দুর্বোধ্যতা আর সরলতার বাসি গন্ধ। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিলো অনেকে। কেননা ছোটবেলায় পুড়ে যাওয়া কুঁচকানো চামড়া জড়ানো আঙ্গুল - কেউ হাসতে হাসতে তাকালো ওর বুকের দিকে, শুকনো অপুষ্ট স্তনরেখা উল্লেখযোগ্য নয় মোটেই - কিন্তু কেউ চোখ তুলে ওর চোখের দিকে তাকালো না - অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব, তাহমিনা ভাবে, এদের।

    ‘ছার এই নেন নুন!’
    পান্তা নয়, তন্দুরের গোল চুলার ফোস্কা পড়া রুটি। ঝোলের হলুদ লেগে রুটিতে জমে থাকা অবশিষ্ট সোডা ফুটকি ফুটকি লালচে রঙীণ হয়ে উঠছে। হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কাশেম ভাবে কোনো এক উপচে পড়া ডাস্টবিনের কথা। একটা কুত্তাকে দেখা যেতো; রোগা, ঘা ঘা পিঠ। নিঃশব্দে বসে আছে, উচ্ছিষ্ট খাবে সেই শক্তি নাই। তাই খাবারের কাছে বসে থাকে। খুব ক্ষুধা হয় একথা মনে পড়াতে। হাতের আঙ্গুল খাওয়ার মুদ্রা ফোটাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে, তীব্র উত্তেজিত হয় পাকস্থলী, চোখে কামনার সময়কার লাল। কালো গোঁফের আড়ালে বাদামী সরু সরু আঙ্গুল সাদা রুটির টুকরো হলুদ ভাজি মুড়ে লাল লাঞ্চের হাঁয়ের ভিতর ঠেলে দিতে থাকে।

    শেষ বিকেলের কাকদল একটি নিরিবিলি পাঁচিলের উপর সার বেঁধে বসে গুপ্তসভা করছে। কারো মুখে রা নেই, কাড়াকাড়ি নেই, পুরীষ ত্যাগে ইচ্ছা হচ্ছে না টাকের ওপর, পাখা ঝাড়ার আগ্রহ নেই; নখ দৃঢ় করে চেপে রেখেছে কাঁচ বসানো দেয়ালে। কাকেরা সভা করছে। রিকশর বিষয় নিয়ে? রাস্তা খুঁড়ে টেলিফোন লাইন মেরামত নিয়ে? কোনো বাগান উন্নয়ন, প্রিক্যাডেট শিশু শিক্ষা, অনুপম নার্সারী বা নার্সিং হোম নিয়ে?

    না, ওদের বিষয় এই বিকেল, যে বিকেলের দাঁড়ে ওরা বসে আছে; অথবা ওরাই বিষয়, এই লোকঝরা মরা বিকেলের - যখন অফিসের বাতি কমে আসে, পেতলের উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে যায়। কাকেরা গবেষণা করে মানুষের ভবিষ্যত ও বর্তমানের হতাশা নিয়ে - যখন হালকা গল্পগুজব করে বিকেল মাখাবে, সেই সময় সে কান্ত হয়ে ঝিমাচ্ছে, পেট খিচে আত্মগোপন করে আছে - এই সব বিষয় নিয়ে।

    সবুজ করুণ এ দেশটার যোনীমুখী আচরণ দেখে দেখে কান্ত হয়ে পড়ে পাথরকুঁচি। বেলেল্লেপনার সীমা আছে! যে তেজই থাকুক না কেন। ভোট কেটে কেটে আর টগবগে বানোয়াট কথা বলে একটি দেশকে পাল্টানো যায় না। জয় হলো প্রকৃত পেশীর কাজ। এমন একটা দেশ, যেখানে দেশপ্রধান মধ্যরাতে কাঁদে। এমন একটা দেশ চাই। প্রিয় জনগণ, আপনারা আসুন, দেখেন কি আয়োজন দরকার আপনাদের। খেল্ খেল, ভানুমতির খেল। একটা প্রজন্ম আত্মবলিদান না করলে কখনোই নাগরিক ফুটে উঠবে না।

    লোকটা তাকাতে তাকাতে দেখে কখন অন্ধকার রেখে চলে গেছে দিন। পিভিসি পাইলের উপর শুয়ে কি মমতায় পাইপ জড়িয়ে শুয়ে আছে কিশোর ফেটিগ। লোকটি সামনে তাকায়, পেছনে তাকায় - সর্বত্র নাগরের অশ্লীল খোঁড়াখুঁড়ি। গালাগাল সর্বদা - ‘শালা কুত্তার গু, আঠা জড়াইয়া বইছো’ - টেম্পোর হেলপারের ঘুম জড়িয়ে আসে চোখে বিকেলের আগেই। পাদানির উপর দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে নিতে হয় কয়েক মিনিট করে ঘন্টায় ঘন্টায়। ঘুমের পিছলা পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে সবার ইচ্ছায়।

    চলো, চলো করি। গাছের বাকল বদলা করি। বছরের পর বছর ফুল সেই গাছে, মেঘ তারা আসে। তবুও কি করি, কি করিলে। একটা বৃহৎ ‘কি করিলে কি হয়’ চাই। সবাই উঁচু করে হাত ধরে এগিয়ে চলছে, বিশৃঙ্খলার লাইন ধরে গুটিসুটি পায়ে - কি করিলে কি হই।

    দৈনিকের পাতায় বিজ্ঞাপনে লেখা:
    বাড়ী বিক্রয়: দেড়গন্ডা জায়গার উপর তিনতলা বাড়ী, চকবাজার সিরাজদ্দৌলা রোডের নিকট বিক্রয় হইবে। সম্পূর্ণ মশার জাল, ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যবস্থা এবং ইংলিশবাথরুম দ্বারা সুসজ্জিত। ফোন নং...।

    এসময় এরকম ভাষা কেউ ব্যবহার করে না। জমির মাপ বলে কাঠায়; মশার জাল না বলে বাড়ীর মালিকেরা বলে রডেন্ট ও ইনসেক্ট ফ্রি। ইংলিশবাথরুম আবার কি?
    এ দেশের মানুষ পায়খানার ব্যবহার জানে না। আবহামান বাংলা ছিলো দারিদ্রের। পিছনে যতদূর চোখ যায় ক্ষুধারই চিত্র। ক্ষুধার্ত মানুষের স্রোত। অসম্ভব দারিদ্র এখানে।
    ইংলিশ বাথরুম বলতে কি বুঝায়? টাইল, বেসিন, লুকিং গ্লাস, কমোড, বাথটাব, শাওয়ার-গরম/ঠান্ডা পানির, লোশান, কন্ডিশনার, ফেনা, সুগন্ধি, স্পেস, একাকীতা? একটা দৃষ্টিভঙ্গী, একটা মানসিক অবস্থা?
    বিজ্ঞাপনদাতার বাস এ দেশেই। তার সাথে কখনো কি রাস্তায় দেখা হয়? রিকশয় পা তুলে যাচ্ছে, ঈদে বাজার করছে, পত্রিকা দেখে উত্তেজিত হচ্ছে? গরমে হাসফাস, আর্দ্রতা এবং মশককুল থেকে নিজেকে সর্বদা রার আয়োজন। কিন্তু বাড়ী বিক্রি করবেন কেন?

    ইচ্ছে হয় এরকম বিজ্ঞাপন ছাপি
    বিক্রয়: টয়োটা করোলা, জি এল সেলুন ১৯৮৪ এ্যালয় হুইল, বিল্ট ইন এসি ক্যাসেট রেডিও ঘড়ি ফ্যাব্রিক সীট রেজিঃ মে ’৮৯ দাম ৪,৬০,০০০ সনি ২১” রংগীন টিভি ২৫,৫০০ প্রকৃত ক্রেতারা যোগাযোগ করুন।
    আসলে এই বিজ্ঞাপনটিও ছাপা হয়ে গেছে। কিছুলোক এই দ্রব্যসামগ্রীগুলো ব্যবহার করে বিক্রি করে দিচ্ছে। কিন্তু বিক্রি করছে কেন? দাড়ি কমাহীন, ভালবাসাহীন? এ জীবনে কি কিছুই চিরদিন থাকবার নয়? কোথাও কিছুতেই কি সন্তুষ্টির হাতছানি নেই?

    এখন যদি কোন দীর্ঘ প্রস্তুতির জঙ্গল থেকে ওলের মতো কড়া আর সজারুর কাঁটার মতো তীব্র আর গোপন কোনো রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে আসতে চান, তাহলে অতীতে পাটির-গোপনতা-রক্ষার-জন্য-শহীদ সদস্যদের কি করবেন?

    শূন্য মাথায় চুল ছিঁড়ে আবছার কেবল বলেন, ‘আহ্হারে!’
    এর কাছে ফিরিয়ে দিলে সেই বারোটি বছর, সে আবার নতুন করে বেঁচে থাকার জন্য রাজী। সব কিছু ভুলে যাবেন, যেভাবে সেই বিখ্যাত দেয়াল লিখনও ভুলে গেছেন।

    বলতো শালারা শুয়োরের বাচ্চারা
    নিক্সন-কোসিগিন তোদের মা-বাপ কিনা
    আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি
    চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।


আবসারের সাফল্যের সম্ভাবনা কত?
প্রশ্নটির উত্তরে বলা যায়ঃ শেষ সিগারেটটি দেশলাইয়ের সর্বশেষ কাঠির আগুনে ধরানোর সম্ভাবনা যতটুকু। কত? এটা একটা জাজমেন্ট, একাউন্টেন্সি নয়।

    হে ভাইয়েরা, দেখুন, ওখানে পাঁচটি লোক বসে আছে, ওরা তাসের দেশের লোক, ভাঁজে পরে সাইজ হয়ে আছে। সর্বত্র ছড়িয়ে আছে স্বাধীনতার তাসের প্যাকেট। রাজার ছবি - চ্যাপটা রাজা। ঐ যে দেখুন রাণীর ছবি, মুখমন্ডল গোলাকার ও কাটা চিবুক। চোখে চিলের ডিম, গলগল করে তাকায়।

    বিকেলের কাকদলের কাছে ঢিল ছুঁড়েছে কেউ। এই দৃশ্য দেখার জন্য ফটো কপিয়ারের ভিতর থেকে ছাপানো ফর্ম বেরুল। ফর্মে কতগুলো প্রশ্ন আঁকা। কাকদের পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য। কটা, কি রং? সাইজ? স্বর কতো রকম? স্বর শুনে জ্বর হয় কারো? সর্দি? মন ভালো হয়? কখন এরা হাসে? আকাশের রং কি তখন? উত্তরমালা থেকে সারণী হবে। খালেক সাহেব লিখতে বসবেন, ধানের চাষ বাড়ানো হোক, তাহলে ইঁদুরের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটবে। কাক নতুন খাদ্যে বেশী ক্যালরী পাবে। গ্রাম উন্নয়ন দরকার, কেননা আগে কাকের স্বরবিন্যাস এখনকার চেয়েও মিষ্টি ও মধুর ছিলো। সারণী থেকে দেখা যাবে, যেদিন ভাল খাবার পায় সেদিন ওদের মিটিং করার প্রবনতা কমে যায় প্রায় ১৮%, এতে ওদের জনপ্রিয়তা ৩৭.৩৫% থেকে বেড়ে ৬২% হয়।

    টীম লিডার ডঃ আলমগীর বলবেন, ‘আরে করেছেন কি, এসএআর এ লেখা আছে দেশে ক্ষুধার তীব্রতা সমান রাখতে হবে, শস্য উৎপাদন বাড়ানো যাবে না, কাটুন আপনার রিমার্ক। টেবিল থেকে বলুন, মানুষের পরিবেশ সচেতনতার কথা। ইঁদুর নিধন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। এই সাথে প্রয়োজন হলো এর সাইজ বৃদ্ধি আর যাতে সহজেই শিকার ধরতে পারে তার জন্য জিনে পরিবর্তন এনে ইঁদুরগুলোকে বানাতে হবে ঠান্ডা ও ধার্মিক। নইলে ওয়ার্ল্ডব্যাংক মন খারাপ করবে।’ খালেক সাহেব শিউরে ওঠেন, ‘না, না, তা তাও ক্কি হয়’ - বলে ঢোক গেলেন।

    এমেরিকান অয়্যারহাউজ পারদের আলোতে খলখল করছে রাত্রিবেলা। কুকুরকুন্ডলীর মতো রাত জায়গা করে নিচ্ছে রাস্তার বাঁকে, গর্তে, বিছানায়, মানুষের চোখে, দ্রুতগামী যানবাহনে।

    অফিসটি চাপা ফুলের রং নিয়ে রাতের আকাশের নিচে অবাক হয়ে পৃথিবীর দিকে তাকাচ্ছে। ভেতরে চেয়ার, টেবল, কপিয়ার, পিসি’র মনিটর নিস্পলক হয়ে সবাই সবাইকে দেখছে। ফরমিকার টেবলে পোকা ডাইভ দিচ্ছে। গুটি কতক লোক গন্তব্যহীন দেশের নাড়ী টিপে রোগ ধরার চেষ্টা করছে তথ্যগণিত থেকে। সংসারে এদের বুঝি কেউ নেই। জবরজং গোদা পায়ে সংসার অন্যদিকে চলে গেছে। সেই কবে, মনেও নেই কৈশোরের বলকানো রক্তস্রোতে ভেসে পড়েছিলেন নন্দন কাননের স্বপ্নে। আজ বিশ্বব্যাংক হো হো করে হাসছে, এদিকে এমেরিকান অয়্যার হাউজের সলজ্জ তিরস্কারঃ বাপু, সেই তো এলি, খামোখা পানি ঘোলালি। মাঝখান থেকে যৌবনটা ফউৎ; চিংড়ির ব্যর্থ রক্ত; আসলে আরশই ছিলো না কোনো। বেঁচে থাকতে হলে কথা কম কাজ বেশী। হাহ্ হা। অতো সিরিয়াস হওয়া ছাড়ো তো বাপ!

রচনাঃ ১৯৮৯
পুস্তক: কাছিমগালা

1 comment:

ferari_ekjon said...

kajol bhai...

eta amar apnar lekha onnotomo prio golpo...ar ei boita shobshomoyi amar sathe thake... literally na..mone mone...aar ei bishesh golpo tar shaad ektu beshii pai mone hoy.... kothay jeno nijer jiboner bertho somoyer mil pai...

aaro lekhen..... aaro bhalo kichu lekhar prottashay...