স্বাক্ষাৎকার - 'কথা' লিটল ম্যাগাজিন। (১ম অংশের পর...)
হ্যাঁ, তা হা নয় মানলাম, কিন্তু কথা হচ্ছে তখন প্রগতিশীল রাজনীতির ধারার কিন্তু বিকাশ ঘটল। আমরা তাদের ডেডিকেশনটাও দেখলাম। কিন্তু আপনার এধরনের লেখা বিশেষত রোকনের মৃত্যু বা বাবা নুরদীন-এ কিন্তু এর কিছুই দেখিনি।
লেখার কাজ কিন্তু ঐটা না। আমি সবসময় যেটা বলি, তা হচ্ছে, লেখা আমার সময়টাকে বুঝাইতে পারে, তা কিন্তু কোনো কিছুকে তৈরী করে না। সে সামাজিক বাস্তবতার পিছনে পিছনে যায় আর-কি। যে কথাগুলি আপনি দেখতে চাইলেন, ওইগুলি আসলে স্বপ্ন কথা হচ্ছে, ধরুন, একটা শক্তি অর্গানাইজড হওয়ার আগে অনেক মালমশলা লাগে তো? প্রণোদনা, ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি লাগে। দ্বান্দ্বিকতার অনেক লেয়ার আছে। শিল্প যা করে তা হচ্ছে, যদি মানুষের মনে তা থাকে, তা সে বের করে নিয়ে আসতে পারে। সে মানুষের মনে সেটা ঢুকাতে পারে। ক্ষমতা বদলানোর কাজটা কিন্তু নেতৃত্বের। একজন রাজনৈতিক নেতা স্বপ্নকে নেতৃত্ব দিতে পারে, আর শিল্প-সাহিত্য সেটা জাগাইয়া দিতে পারে। মানুষগুলি আগায়ে গেলে শিল্প-সাহিত্য তা রূপায়িত করতে পারে। কিন্তু তা জোর করে করার বিষয় না।
আমার কথাটাকে আরেকটু পরিষ্কার করতে চাই, স্বাধীনতারপর পর কিন্তু জনমনের ব্যাপক জাগরণ হলো, সর্বহারা পার্টি, আব্দুল হক বা তোয়াহার পার্টি, জাসদ ইত্যাদি হুহু করে বাড়তে থাকল। তার মানে মানুষের ভিতর তখন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ষ্পষ্ট হচ্ছিল। আমার কথা হচ্ছে, ওইধরনের পটভূমিতে আপনার গল্প আছে ঠিকই কিন্তু মানুষের সেই স্বত:স্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষাকে আপনি ধরতে চাননি।
কথা হচ্ছে, আমিও কিন্তু সেই ধরনের বিপ্লবী ক্যারেক্টারদের ভিতরই বড় হইছি। আপনি তো বাজিতপুরের সশস্ত্র বিপ্লবের কথা জানেনই। আবার কিশোরগঞ্জে কিন্তু নগেন সরকারসহ আরও মারাত্মক বিপ্লবীরা ছিলেন। এদের ব্যাপারগুলি কিন্তু আমি ভালো করেই জানি। আমি কিন্তু লেখাপড়ার পাশাপাশি এইধরনের লোকগুলি ধারেকাছেই বড় হইছি। আমার সিনিয়র বন্ধুরা আঙ্গুল কেটে রক্তে নিজের নাম লিখে ওই পার্টি করত। এরা কিন্তু পুরাজীবনটাই ওইসবের পিছনে ব্যয় করছে। কিন্তু ব্যাপার সেটা না, এর এক-একটা সময়ের এক-একটা ভাষা থাকে তো। এখন ধরেন, আমাদের যদি ১৯২০ সালের দিকে জন্ম হতো তাহলে কাজী নজরুলের ভাষায় সবকিছু ভাবতাম। আমি বলতে চাচ্ছি, ১৯২০ সাল আর ১৯৮০ সাল তো আর এক না। কথা হচ্ছে, স্বপ্নের বহুরকম রং তৈরি হয়। যাই হোক, আমাদের আলোচনাটা বোধ হয় অন্যদিকে চলে যাচ্ছে, অবস্টাকল তৈরি হচ্ছে।
তার মানে আমরা কি এটা ধরে নেবো যে রাজনীতির এইধরনের আলাপ আপনার ভাল্লাগছে না?
না না তা নয়, এখানে দুইটা জিনিস আর-কি, রাজনৈতিক চেতনাকে দুইভাবে দেখা যায়। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের কথাই ধরেন, শেখ মুজিব যেদিন নিহত হলেন, আমাদের পরিবারের সবাই কিন্তু ভীষণভাবে আহত হয়েছিল, আমরা সবাই কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। আবার যখন আমি বিকালে বাইরে গেলাম, তখন যারা গোপন-বামপন্থি রাজনীতি করত তাদের সাথে দেখা হলো। সেখানে নগেন সরকারের সাম্যবাদী দল, অন্য গ্রুপ ছিল, জাসদ ছিল - তখন তাদের ইন্টারপ্রিটেশন ছিল একদম ভিন্ন। তখন আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। তখন মনে হল, আমি তাহলে কোনটা গ্রহণ করব! আমি তখন এত গভীরভাবে জানি না যে কোনটা ঠিক। তখন কিন্তু বলা যায়, ওদের দ্বারা আমি এক বেলার জন্য নিষ্ঠুর হয়ে গেলাম, মনে হল, ব্যাপারটা তাহলে হয়ত অন্যরকম কিছু। তার মানে ব্যক্তিগত অনুভূতি আর পলিটিকাল এনালাইসিস এক হয় না। এতে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেল, এরা যারা পলিটিকাল ফ্রেমওয়ার্কে থেকে পার্টিজান হয়ে আছে তাদের ভিতর একধরনের যান্ত্রিকতাও আছে। আমি অনেক কিছুই পাঠ করছি, অনেক কিছুই অনেক ভাবে দেখেছি। আমার তখন মনে হলো - না, এই ভাবে আমার যাওয়া সম্ভব না। তখন আমি অনেক আলোচনায় অংশ নিয়েছি। ওই বয়সেই খুব পাকা ছিলাম তো (হা হা হা)। আমার কাছে অনেকে আসত, আমিও অনেকের কাছে গেছি। এমনকি ময়মনসিংহে এগ্রিভার্সিটিতে পড়ার সময়য়েও আমার রুমে অনেক দলের আগাগোনা ছিল। তবে কখনই আমি কিন্তু ওই ফ্রেমের ভিতর ঢুকে যেতে পারিনি। আমি একটা বিষয় বুঝি, যখন বড় জোয়ার আসে, তখন কিন্তু ছোট ছোট বাঁধ আর থাকে না, ভেঙে যায়। ওই যে বড় জোয়ার, তা কিন্তু এখানে আর আসছে না। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি হওয়ার পর থেকেও অনেক দিনেও কিন্তু শ্রেণীসংগ্রামের বড় জোয়ারও তৈরি হয় নাই। সেই জোয়ার তৈরি হয়নাই বলেই হয়ত আমি সক্রিয়ভাবে সেসবের সাথে যাইনাই। তবে এটা সত্যি যে, কায়েদে আজমের জীবনী পড়ার সাথে একেবারে সস্তা কাগজে ছাপানো চারু মজুমদারের জীবনী পড়ে আলোড়িত হই। কারণ, এইখানে আমি দেখি - এক. চারু মজুমদারের ফাইটিং স্পিরিট। দুই. তার মানুষকে বাঁচাতে চাওয়া। তার কাছে যে যায় তাকেই সে বদলে ফেলতে পারছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সে কাজটা করেছিল সম্পূর্ণ লোভশূন্য হয়ে।
আপনি লেখালেখির বিষয়টাতে যখন এভাবে নিজেকে রাখতে চাচ্ছেন, আমি একটা বিষয় জানি, আপনি কবিতাও লিখে থাকেন। তো, গল্প আর কবিতার পার্থক্যটা আপনি কিভাবে করেন? আপনার লেখালেখির প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কেও বলুন।
এই সম্পর্কে বলতে গেলে আমার কিছু বাল্যকাল বলতে হয়, আমার বয়স তখন ১৪, তখন আমি প্রথম কিশোরগঞ্জ যাই। তো, সেই বয়সে একজায়গায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া খুব সহজ নয়। ওইখানে একটা লাইব্রেরি ছিল, সেইখানেই আমি যেতাম। তখন ভাবিনি যে আমি লিখব। আমি তখন প্রচুর পড়তাম। তখন পারভেজ নামের এক বন্ধু জুটে যায়। সে লিখত - শুধু লিখত না, প্রেমে পড়ে লিখত। প্রতিদিন একটা করে গল্প লেখে। ও খুবই রোমান্টিক। আর আমি ওর লেখার এনালাইসিস করতাম। এরকম অনেককেই আমি প্রেম-বিরহ-আসা-যাওয়া এসব নিয়ে বৈদগ্ধতা দিতাম। মানে এইদিক থেকে আমি হলাম ওদের তাত্ত্বিক। তবে খুব মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই বন্ধু আমার এখন খুবই ম্যাটারিয়ালিস্ট। এখন সে ইহজাগতিকতার ভিতর ডুবে আছে। যা বলছিলাম, তখন বুঝলাম যে, হ্যাঁ লেখাটা তো এরকম না, লেখাটা তো ওইরকম হওয়া দরকার ছিল। ওরা কিন্তু সেইটা বুঝতেই পারে না। তখন আমি ওদেরকে দেখানোর জন্য কঠিন কঠিন কবিতা লিখতে শুরু করি। কারণ আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ার আগেই, ধরেন, ওই সুধীন্দ্রনাথ পড়তে শুরু করছি। তখন পারভেজকে দেখানোর জন্য গল্পও লিখে ফেললাম। এইভাবে গল্প-কবিতা লিখে ফেললাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করবো। ওই সবার সাথে যোগাযোগ করল। সবকিছুর আয়োজন হল। কিন্তু যখন প্রিন্টার্স লাইনে নাম দেয়ার সময় হল তখন আমরা কেউই সেইভাবে জানি না যে কোন পদের কি অর্থ। তবে পারভেজ যেহেতু সবকিছু করছে, ওকে আমরা বানালাম নির্বাহী সম্পাদক। আর যেহেতু আমি প্রুফ দেখছি, কার কার লেখা যাবে না-যাবে ইত্যাদি করেছি, সম্পাদকীয় লিখেছি - সেই জন্য আমি হয়ে গেলাম সম্পাদক। হা হা হা।
No comments:
Post a Comment